অণুগল্প- জীবনের রঙ

জীবনের রঙ
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

এখনতো অখন্ড অবসর বিশ্বনাথবাবুর। রিটায়ার করেছেন বারো বছর হয়ে গেলো … বউ মিনতিও চলে গেছে পরপারে…তিন ‘বছর হয়ে গেলো। এখন তিনি বড় একা। মিনতি থাকতে তিনি বোঝেননি যে শান্তশিষ্ট পত্নী তার জীবনের কতটা জুড়ে ছিলেন। মিনতি কতটা মায়ার বন্ধনে তাকে বেঁধে রেখেছিলেন।
বিশ্বনাথবাবুর দুই ছেলে, এক মেয়ে। সবাইকেই লেখাপড়া শিখিয়েছেন…বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে হায়দ্রাবাদে থাকে পরিবার নিয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে মুম্বাইয়ে। একমাত্র ছোট ছেলেই কলকাতায় ওনার সাথে থাকে। ছোট ছেলে, ছেলের বউ আর নাতি…বিশ্বনাথবাবুর সংসার।

ছোট ছেলে বাবাকে বাজারদোকান করতে দেয় না, বলে সারাজীবন অনেক খাটলে, ছোটাছুটি করলে… এখন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে এত কাজ আর করতে হবে না। তুমি শুধু খাও-দাও, ঘুমাও আর বেড়িয়ে বেড়াও।

বিশ্বনাথবাবু প্রথম প্রথম রিটায়ার করার পর অনেকটা সময় কীভাবে কাটাবেন বুঝতে পারতেন না। আগে দিনের একটা বড় অংশ অফিসেই কেটে যেত। ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই রাত হয়ে যেত। তারপর খাওয়াদাওয়া করে খবরের কাগজটা নিয়ে শুতে শুতেই ঘুম জড়িয়ে আসতো দু’চোখে। আবার ভোর হলেই উঠে দিনের নানা কাজ শুরু করতেন… সকাল সাত’টাতেই বেরিয়ে যেতেন… অনেক দূরের অফিস। বাড়ির লোকের সাথে ছুটির দিন ছাড়া কথা বলারই তেমন সময় পেতেন না।

এখন ওনার হাতে অনন্ত সময় কিন্তু ওনার আশেপাশে সবাই ব্যস্ত… ছুটে চলেছে। একা একা বসেবসে কত চিন্তাভাবনা আসে মাথায়। কখনো কখনো ছোটবেলার কথা মনে করেন…কত গল্প…ছোট বৌমা সামনে থাকলে তাকেই বলেন তাঁর সোনাঝরা সবুজ দিনের কথা। অল্পবয়সে অনেক বন্ধুবান্ধব ছিলো… এখন পুরোনো পাড়া থেকে অনেক দূরে চলে এসেছেন। ফোনে যোগাযোগ হয় তাদের সাথে। কিন্তু যেতে পারেন না।ছেলেমেয়েরাও রোজ দূর থেকে ফোন করে খবর নেয়। খুব দেখতে ইচ্ছে হয় ওদের।

আর ছোটনাতি পড়াশুনো, কোচিং, গিটার ক্লাসের ব্যস্ততার ফাঁকে দাদুর কাছে এলেই দাদুর মন খুশী হয়ে যায়। নাতির প্রাণচঞ্চল ভালোবাসায় দাদুর মনে, জীবনের সবুজ রঙের ছোঁয়া লাগে। সতেজ হন তিনি। একমাত্র তখনই বাঁচতে ভারী ভালো লাগে তাঁর। নয়তো নানা অসুখবিসুখ আর বিয়োগব্যথায় বাঁচার ইচ্ছেটা কমে যাচ্ছে আজকাল।

দুপুরে খাওয়ার পরে ইজিচেয়ারে এসে বসেন তিনি। তারপর বই, কাগজ পড়েন। একটু ঝিমুনি মত আসে তখন। তারপর বিকেলে খেলার সঙ্গী এলে দাবা খেলেন।

আজ ইজিচেয়ারে আধশোয়া বিশ্বনাথবাবু।চোখদুটো বোজা। টেবিলে দাবার বোর্ডটা পাতা। সামনের চেয়ারটা ফাঁকা। রোজ বিকেলের খেলার সাথী বিজন আর কোনোদিনও আসবেনা…চলে গেছে চিরতরে। মনটা আজ বড্ড খারাপ। সন্ধ্যা হয়ে এল। ঘরে অন্ধকারের দীর্ঘ ছায়া। কে যেন ঘরের আলোটা জ্বেলে দিলো–তাকিয়ে দেখেন ছোটনাতি প্রমিত।

-দাদান, চলো এক দান হয়ে যাক্।
-চলো,দাদুভাই।
কাঁপা হাতে সাদা-কালো ঘুঁটিগুলোকে সাজাতে থাকেন বিশ্বনাথবাবু।।

Loading

2 thoughts on “অণুগল্প- জীবনের রঙ

Leave A Comment